রাজাকার ভারতীয় উপমহাদেশীয় শব্দ। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্থান তিন দেশেই রাজাকার শব্দের ব্যবহার আছে। রাজাকার শব্দটি যুদ্ধ, সংগ্রামের সাথে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্থান, ১৯৭১ সাল, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, যুদ্ধ পরবর্তি বাংলাদেশের রাজনীতি, আন্দোলন, সংগ্রাম ইত্যাদির সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত এই রাজাকার শব্দটি। অর্থাৎ এটি ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতির সাথে জড়িত। বিশেষ করে বাংলাদেশে বহুল আলোচিত ও সমালোচিত শব্দ।
ভারত ও পাকিস্থানে শব্দটি উপকারী, ভালো বা পজিটিভ অর্থে ব্যবহার করা হতো। এখনও হয়। তবে স্থান, কাল, পাত্রভেদে এটি এখন নেগেটিভ অর্থাৎ ঘৃণাবাচক শব্দে পরিণত হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশে এটি বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহী ও ঘৃণিত ব্যাক্তিকে নির্দেশ করতে ব্যবহৃত হয়।

রাজাকার অর্থ
বাংলাদেশে ব্যবহৃত রাজাকার শব্দটি মূলত উর্দু ও ফারসি ভাষার শব্দ। যার বাংলা অর্থ ‘স্বেচ্ছাসেবক’। আর হিন্দি অর্থ ‘স্বয়ংসেবক’। উর্দু শব্দ ‘রেজাকার’ বা ‘রেযাকার’ থেকে বাংলা ‘রাজাকার’ শব্দের উদ্ভব। বিভিন্ন ভাষায় রাজাকার শব্দের অর্থ নিচে তুলে ধরা হলো:
উর্দু অর্থ:
উর্দু শব্দ রেজাকার বা রেযাকার থেকে বাংলা রাজাকার শব্দের উদ্ভব। উর্দু রেজাকার এর বাংলা অর্থ “স্বেচ্ছাসেবক”। সাধারণত কোনো স্বেচ্ছাসেবী কাজে নিযুক্তদের বোঝাতে রেজাকার শব্দ ব্যবহার করা হয়ে থাকে।
ফারসি অর্থ:
ফারসি ভাষাতেও রেজাকার শব্দের ব্যবহার আছে। ফারসি ভাষার রেজাকার শব্দটি ‘রেজা’ এবং ‘কার’ এই দুটি শব্দ থেকে রেজাকার শব্দের উৎপত্তি। রেজা (Raza) অর্থ সন্তুষ্টি, সম্মতি বা ইচ্ছা। কার (Kar) অর্থ কাজ বা কর্ম। ফারসিতে ভালো কাজে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের বোঝাতে রেজাকার শব্দ ব্যবহৃত হয়।
হিন্দি অর্থ:
হিন্দিতে রাজাকার শব্দটি ফারসি ও উর্দু থেকে নেওয়া। রাজাকার শব্দের হিন্দি অর্থ ‘স্বেচ্ছাসেবক’ এবং ‘স্বয়ংসেবক’। ভারতীয়রা রাজাকারদের ইংরেজিতে Volunteer বলে। যে স্বেচ্ছায় কোনো কাজ করে, বিশেষ করে সামাজিক বা সামরিক কাজে সাহায্য করে, এমন কাউকে বোঝাতে স্বেচ্ছাসেবক’ এবং ‘স্বয়ংসেবক’ শব্দ ব্যবহৃত হয়।
বাংলা অর্থ:
বাংলা ভাষাতেও স্বেচ্ছাসেবক অর্থে রাজাকার শব্দের ব্যবহার করা হতো। রাজাকার বলতে স্বেচ্ছাসেবকদের বোঝানো হতো। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় এই রাজাকার বাহিনী বাংলাদেশীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। স্বাধীনতা পরবর্তি বিভিন্ন রাজেনৈতিক দল ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য রাজাকার শব্দটিতে নেতিবাচক হিসেবে ব্যবহার শুরু করে। পাঠ্যপুস্তকে রাজাকার শব্দটিকে নেতিবাচক হিসেবে সঙ্গায়িত করা হয়। ফলে, ধীরে ধীরে রাজাকার শব্দটি বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহী, ঘৃণাবাচক, নেতিবাচক শব্দে পরিচিতি পায়।
বিভিন্ন অর্থ রাজাকারের ব্যবহার
রাজাকার বাহিনী কোথাও দেশের পক্ষে, কোথাও দেশের বিপক্ষে কাজ করেছে। কোথাও সাধারণ কাজে, কোথাও যুদ্ধক্ষেত্রে। কোথাও মিলিশিয়া/ প্যারা-মিলিশিয়া বাহিনী হিসেবে, কোথাও সেনাবাহিনীতে সহায়তা করেছে। কোথাও দেশপ্রেমিক, কোথাও দেশদ্রোহী। তাই অবস্থাভেদে রাজাকার অর্থ ভিন্নতা পেয়েছে। যেমন:
১. সাধারণ অর্থে (মূল অর্থ) — স্বেচ্ছাসেবক
উর্দু ও ফারসি ভাষায় “রেজাকার” শব্দের অর্থ হলো “স্বেচ্ছাসেবক”। যে স্বেচ্ছায় কোনো কাজ করে, বিশেষ করে সামরিক, সামাজিক বা মানবিক কর্মকাণ্ডে নিযুক্ত বাহিনীকে রাজাকার বা স্বেচ্ছাসেবক বলে।
২. সামরিক ও রাজনৈতিক অর্থ
রাজাকারের সামরিক অর্থ যোদ্ধা, সহযোদ্ধা, যুদ্ধে সহায়তাকারী। ব্রিটিশ ভারতে “রেজাকার” বলতে হায়দ্রাবাদ রাজ্যের নিজামের পক্ষে লড়াই করা একটি মিলিশিয়া বাহিনীকে বোঝানো হতো। যারা ভারতের স্বাধীনতার সময় (১৯৪৭) ভারতের অন্তর্ভুক্ত হতে চায়নি। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছিল। পাকিস্তানেও “রেজাকার” বলতে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী বোঝানো হতো, যারা সামরিক বা আধাসামরিক কার্যক্রমে অংশ নিত।
৩. বাংলাদেশে নেতিবাচক অর্থে — বিশ্বাসঘাতক
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় গঠিত একটি স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীকে “রাজাকার” বলা হতো।
- এরা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কাজ করত,
- পাকবাহিনীকে সহায়তা করত,
- নিরীহ বাঙালিদের উপর নির্যাতন চালাত।
যার ফলে বাংলাদেশে “রাজাকার” শব্দটি এখন “বিশ্বাসঘাতক”, “দেশদ্রোহী” ও “ঘৃণিত সহযোগী” অর্থে ব্যবহৃত হয়।
রাজাকার কারা?
ইতিহাসে বিভিন্ন দেশে রাজাকার বা মিলিশিয়া বাহিনী কখনো নিজ দেশের পক্ষে, আবার কখনো শত্রুপক্ষের সহায়তায় লড়াই করেছে। তাই, দুই দিক থেকেই রাজাকারের আলোচনা প্রয়োজন। নিচে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই ধরনের রাজাকারের বিষয়ে আলোচনা করা হলো:
স্বেচ্ছাসেবক রাজাকার:
রাজাকার শব্দের আভিধানিক অর্থ স্বেচ্ছাসেবক। স্বেচ্ছা বা স্ব-ইচ্ছা পোষণ করে সেবা করা বা সহায়তা করা। রাজাকার শব্দের স্বেচ্ছাসেবক অর্থ যুদ্ধকালীন নিজ দেশের পক্ষকে সহায়তা করা। স্বেচ্ছাসেবক হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি স্বেচ্ছায় বিনামূল্যে বা ব্যক্তিগত লাভের প্রত্যাশা করে না। সমাজ বা অন্যদের কল্যাণে কাজ করেন।
সাধারণত বিভিন্ন সামাজিক, মানবিক, বা পরিবেশগত কাজে সাহায্য করা স্বেচ্ছাসেবকের কাজ। দুর্যোগে সাহায্য প্রদান, দরিদ্রদের সহায়তা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় অবদান রাখা ইত্যাদি ইতিবাচক স্বেচ্ছাসেবা।
স্বেচ্ছাসেবক আধা-সামরিক বাহিনী হিসেবে হতে পারে। আবার সামরিক তথা সেনাবাহিনীকে সহায়তার মাধ্যমে হতে পারে। এ ধরনের রাজাকার নিজ দেশের পক্ষে কাজ করে। ভারতের হায়দ্রাবাদের (১৯৪৭) ‘রেজাকার বাহিনী’ এর উদাহরণ।
দেশদ্রোহী রাজাকার:
যে বা যারা ব্যাক্তি হিসেবে, স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে, মিলিশিয়া বা প্যারা-মিলিশিয়া বাহিনী হিসেবে, যুদ্ধক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর সহায়তাকারী হিসেবে কিংবা যেকোন অবস্থায় নিজ দেশের বিরুদ্ধে কাজ করে, ষড়যন্ত্র করে, শত্রুপক্ষকে সহায়তা করে, নিজ দেশের উপর শত্রুপক্ষের জয়ের জন্য কাজ করে, নিজের ব্যক্তিগত অনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য শত্রুপক্ষকে লেলিয়ে দেয় সে বা তারাই রাজাকার।
এই স্বেচ্ছা সেবা যখন মানবিকতা, নৈতিকতার বিরুদ্ধে করা হয় বা নিজ সমাজ, দেশের শত্রুদের সাহায্যে করা হয় তখন তা নেতিবাচক হিসেবে দেখা হয়। স্বেচ্ছাসেবা যখন দেশের বিরুদ্ধে, দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে করা হয় এবং দেশের শত্রুপক্ষকে সাহায্য করা হয় তখন তাকে দেশদ্রোহী বলা হয়। তখন তারা স্বেচ্ছাসেবক রাজাকার না হয়ে দেশদ্রোহী রাজাকারে পরিণত হয়। যেমন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপ অঞ্চলের কিছু বাহিনী তার দেশের শত্রুপক্ষ জার্মানি তথা নাৎসি বাহিনীকে সাহায্য করে। বাংলার মীর জাফর ব্রিটিশদের সাহায্য করায় এই উপমহাদেশের স্বাধীনতা হারাতে হয়েছিল। ইরাক-কুয়েত যুদ্ধে কুয়েতের একটি বাহিনী ইরাককে সাহায্য করেছিল।
ইতিহাসে বিভিন্ন রাজাকার বাহিনী:
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্যারা-মিলিশিয়া/ আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্যরা রাজাকার নামে পরিচিত ছিল। অনেক দেশে সামরিক বাহিনীকে সহায়তা করা ছিল প্রধান উদ্দ্যেশ্য। বিশেষ করে যুদ্ধের সময়। কোথাও নিজ দেশের পক্ষে। আবার কোথাও দেশের বিরুদ্ধে কাজ করেছে। ইতিহাসে ঘটে পাওয়া কয়েকটি রাজাকার বাহিনীর উদাহরণ দেয়া হলো:
১. স্বাধীন থাকার চেষ্টায় ভারতের হায়দ্রাবাদের রেজাকার বাহিনী:
ভারতের অন্যতম রাজ্য হায়দ্রাবাদ। ব্রিটিশ ভারতের সময়, হায়দ্রাবাদ ছিল একটি স্বাধীন দেশীয় রাজ্য। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার সময়, হায়দ্রাবাদের নিজাম মির উসমান আলী খান ভারতের সাথে যুক্ত হতে চাননি এবং স্বাধীন থাকার সিদ্ধান্ত নেন। তার রাজ্য রক্ষার জন্য “রেজাকার বাহিনী” (Razakar Militia) নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সেনাবাহিনী গঠন করেন। কাসিম রিজভী নামে এক নেতা রেজাকারদের নেতৃত্ব দেন এবং তারা ভারতের সংযুক্তির বিরোধিতা করে। ১৩-১৭ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৮ ভারতীয় সেনাবাহিনী “অপারেশন পলো” চালিয়ে মাত্র ৫ দিনে হায়দ্রাবাদ জয় করে। রেজাকার বাহিনী পরাজিত হয় এবং হায়দ্রাবাদ ভারতের অংশ হয়ে যায়। এখানে রাজাকার বাহিনী তার রাজ্য তথা দেশ কে স্বাধীন করতে/ রাখতে কাজ করেছে।
২. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি সহযোগী মিলিশিয়া বাহিনী:
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানির নাৎসি বাহিনী বিভিন্ন দখলকৃত দেশে স্থানীয় সহযোগী বাহিনী গঠন করেছিল। এই বাহিনীর কাজ ছিল নিজ দেশের উপর জার্মানি তথা নাৎসি বাহিনীর জয় সহজ করা। দেশদ্রোহী কাজ করায় পরে তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে। যেমন:
- Vichy Militia (ফ্রান্স) – ফ্রান্সে নাৎসি-সমর্থিত সরকার “ভিশি ফ্রান্স” গঠন করেছিল এবং তারা জার্মান নাৎসিদের সহায়তা করত।
- Ustasha (ক্রোয়েশিয়া) – এই বাহিনী নাৎসিদের পক্ষে সার্ব ও ইহুদিদের বিরুদ্ধে গণহত্যা চালায়।
- Waffen-SS Foreign Divisions – নাৎসি বাহিনীর হয়ে লড়াই করা বিভিন্ন ইউরোপীয় সহযোগী মিলিশিয়া বাহিনী।
৩. ব্রিটিশ ভারতের দালাল বাহিনী:
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন ভারত দখল করছিল, তখন কিছু স্থানীয় রাজা-জমিদার ও সৈন্যরা ব্রিটিশদের পক্ষে কাজ করত।
- ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে মীর জাফর ও তার অনুসারীরা নবাব সিরাজউদ্দৌলার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রিটিশদের পক্ষে কাজ করে।
- জগৎ শেঠ, উমিচাঁদ ও রায় দুর্লভরা ব্রিটিশদের সহায়তা করেছিল।
ফলে ব্রিটিশরা ক্ষমতা দখল করলে এদের অনেকে পুরস্কার পায়, কিন্তু ইতিহাসে তারা বিশ্বাসঘাতক হিসেবে পরিচিত থাকে। পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করায় মীর জাফর নামটি এখন কাউকে বিশ্বাসঘাতক বোঝাতে ব্যবহৃত হয়।
৪. কুয়েত-ইরাক যুদ্ধে কুয়েতের সাবাহ মিলিশিয়া বাহিনী:
১৯৯০ সালে ইরাক কুয়েত দখল করলে কিছু কুয়েতি ইরাকিদের পক্ষে কাজ করে। এই বাহিনী ইরাকি সেনাদের তথ্য দেওয়া, কুয়েতের প্রতিরোধ বাহিনীকে ধরিয়ে দিত। ১৯৯১ সালে কুয়েত মুক্ত হলে এদের অনেককে বিশ্বাসঘাতক হিসেবে শাস্তি দেওয়া হয়।
৫. বাংলাদেশের রাজাকার:
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। স্বেচ্ছাসেবক বাংলাদেশী যোদ্ধাদের সাহায্য করার পরিবর্তে তারা বিপক্ষ দল তথা পাকিস্থানী হানাদার বাহিনীকে সাহায্য করে। এই বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে কাজ করে, পাকিস্তানি বাহিনীকে সহায়তা দেয়, সাধারণ জনগণের ওপর নির্যাতন চালায়, হত্যা, লুটপাট ও ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধে জড়িত হয়।
স্বাধীনতা তথা মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কাজ করায় রাজাকার শব্দটি স্বেচ্ছাসেবকের মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। জনগণের চরম ঘৃণা ও ধিক্কারের কারণে “রাজাকার” শব্দটি স্বেচ্ছাসেবকের অর্থ হারিয়ে বিশ্বাসঘাতক, দেশদ্রোহী ও নির্দয় ব্যক্তিকে বোঝাতে ব্যবহৃত হতে থাকে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও পাঠ্যপুস্তকে মুক্তিযুদ্ধে রাজাকারের কু-কর্ম তুলে ধরা হয়। রাজনীতিতে ক্ষমতায় টিকে থাকা ও ক্ষমতায় যাওয়ার হাতিয়ার হিসেবে রাজাকার শব্দকে গালি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। ধীরে ধীরে সাধারণ কথোপকথনে এটি গালি হিসেবে প্রচলিত হয়ে যায়। বিশেষ করে স্বাধীনতা বিরোধী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের রাজাকার বলে অভিহিত করা হয়, যা এখনো নেতিবাচক অর্থে ব্যবহৃত হয়।
রাজাকারদের বিচার:
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দেশদ্রোহী ও শত্রুপক্ষের সহযোগীদের বিচারের নজির রয়েছে। দেশভেদে এদের বিভিন্ন শাস্তি দেওয়া হয়েছে। কিছু উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হলো:
- ফ্রান্স: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, নাৎসি-সমর্থিত “ভিশি ফ্রান্স” সরকারের সহযোগীদের বিচারের মুখোমুখি করা হয়। অনেককে মৃত্যুদণ্ড ও দীর্ঘ কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
- নরওয়ে: নাৎসিদের সহায়তা করার দায়ে প্রধানমন্ত্রী বিদকুন কুইসলিংসহ অনেককে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। “কুইসলিং” শব্দটি বিশ্বাসঘাতকের প্রতিশব্দ হয়ে ওঠে।
- ক্রোয়েশিয়া: উস্তাশা মিলিশিয়া বাহিনী, যারা নাৎসিদের পক্ষে গণহত্যায় অংশ নেয়, তাদের অনেক নেতাকে যুদ্ধশেষে ফাঁসি দেওয়া হয়।
- কুয়েত: ১৯৯১ সালে ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের পর, ইরাকের সহযোগী কুয়েতিদের বিচারের আওতায় আনা হয়। অনেককে ফাঁসি ও দীর্ঘমেয়াদি কারাদণ্ড দেওয়া হয়।
বিশ্বাসঘাতক ও দেশদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন দেশে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ দেশের স্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত না হয়।
বাংলাদেশে রাজাকারের বিচার:
২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের বিচার শুরু হয়। অনেককে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আবার, কাউকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
তবে বাংলাদেশে রাজাকারের বিচার নিয়ে প্রশ্ন আছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে যুদ্ধ– সংঘাত শেষ হওয়ার সাথে সাথে রাজাকারের বিচার হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ হলেও তখন রাজাকারের বিচার হয় নি। রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকা ও যাওয়ার জন্য সবাই রাজাকারদের সাহায্য নিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দল আওয়ামী লীগ রাজাকারের দল জামায়াত ইসলামী এর সাথে যুগপথ আন্দোলন (১৯৯৫) করেছে। পরবর্তিতে সরকার গঠন করেছে। আরেক দল বিএনপি জামায়াত ইসলামীর সাথে নির্বাচনী জোট করে কোয়ালিশন সরকার (২০০১) গঠন করেছে।
আওয়ামী লীগ রাজাকারের দল তথা জামায়াত ইসলামীর সুবিধা নেওয়ার পর, নিজ খুটি শক্ত হওয়ার পর, নিজ দলের অবস্থান পাকাপোক্ত রাখার জন্য রাজাকারের বিচার করার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। অন্যদিকে, বিএনপি দল জামায়াত ইসলামীর সাথে জোট গঠন, কোয়ালিশন সরকার গঠন, সরকার পরিচালনা, দেশ শাসন, ২৪ বছর (২০০১-২০২৪) জোটবদ্ধ ও যুগপথ আন্দোলন করার পর ২০২৪ সালে এসে বলছে জামায়াত ইসলামী রাজাকারের দল। তারা স্বাধীনতা বিরোধী তথা মানবতাবিরোধী কাজে লিপ্ত।
অর্থাৎ বাংলাদেশ শাসনকারী ০২ রাজনৈতিক দলই নিজ প্রয়োজনে রাজাকারদের বন্ধু হিসেবে নিয়েছে। আবার, প্রয়োজন ফুরালে তাদের শত্রুর চোখে দেখা শুরু করেছে। আবার সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দ্যেশে এ বিচারের স্বচ্চতা নিয়েও জনমনে নানা প্রশ্ন আছে।
মীর জাফর ও রাজাকার:
যখন কেউ বিশ্বাস ভঙ্গ করে, গোপনে চক্রান্ত চালায় বা বিশ্বাসঘাতকতা করে, তখন তাকে বিশ্বাসঘাতক বোঝাতে “মীর জাফর” বলা হয়।
তবে বিশ্বাসঘাতকতা যদি শুধু ব্যক্তিগত বিশ্বাসভঙ্গের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং শত্রুপক্ষকে সহায়তা করা, দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা এবং নিজের স্বার্থ রক্ষার জন্য দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, তখন তাকে “রাজাকার” বলা হয়। রাজাকার কেবল বিশ্বাসঘাতক নয়; তারা শত্রুর পক্ষ নিয়ে দেশের স্বার্থবিরোধী কাজে লিপ্ত থাকে, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নষ্ট করতে চায়। এজন্য “রাজাকার” শব্দটি আজ ঘৃণা ও দেশদ্রোহিতার প্রতীক হয়ে উঠেছে।
নব্য রাজাকার কারা:
নব্য রাজাকার তারা, যারা আধুনিক সময়ে নিজ স্বার্থে দেশবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়, শত্রুপক্ষকে সহায়তা করে, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। তারা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিকভাবে দেশের ক্ষতি সাধন করে, বিভ্রান্তি ছড়ায় এবং জাতীয় স্বার্থবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত থাকে।