যানবাহনের ক্ষেত্রে টিওএন্ডই শব্দটি বিনাশুল্কে গাড়ি ক্রয় বা আমদানির সাথে সম্পৃক্ত। যদিও এই শব্দটি অনেকের কাছে নতুন, বাংলাদেশে গাড়ি কেনাবেচার বাজারে সেকেন্ড-হ্যান্ড গাড়ির বিজ্ঞাপনে এটি প্রায়ই চোখে পড়ে। টিওএন্ডই ভুক্ত গাড়ি চেনার উপায় না জানলে ক্রেতা অজান্তেই আইনগত ও আর্থিক ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। বাংলাদেশে এর ধরন, চেনার কৌশল, এবং এর সুবিধা-অসুবিধা — সবকিছু এই গাইডে বিস্তারিত জানানো হবে।
টিওএন্ডই ভুক্ত গাড়ি কী?
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে টিওএন্ডই বা TO&E এর আলোচনা ০২ (দুই) ভাবে হতে পারে।
১. সরকারি প্রতিষ্ঠানে টিওএন্ডই :
TO&E – Table of Organization and Equipment→ টিওএন্ডই” (TO&E) ভুক্ত গাড়ি বলতে বোঝায়, সরকারি দপ্তর বা সংস্থার সাংগঠনিক কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত যানবাহন। এই ধরনের যানবাহন সাধারণত সরকারি কাজে ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ করা হয়ে থাকে এবং এদের রক্ষণাবেক্ষণ ও ব্যবহারের জন্য কিছু নিয়মকানুন থাকে।
২. অন্যান্য ক্ষেত্রে টিওএন্ডই:
TOE: Tax on Exemption → কোন পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হলে আমদানি শুল্ক দিতে হয়। কিন্তু অনকে সময় সরকার বিশেষ ক্ষেত্রে এ শুল্ক মওকুফ করেন। অর্থাৎ সরকারকে কোন আমদানি শুল্ক দিতে হয়ে না। সরকারকে আমদানি শুল্ক না দিয়ে বিশেষ এই সুবিধায় আমদানিকৃত গাড়ীগুলোই টিওএন্ডই ভুক্ত গাড়ী। করমুক্ত সুবিধা পাওয়া কোনো জিনিস (যেমন প্রবাসী, কূটনীতিক বা আন্তর্জাতিক সংস্থা করমুক্তভাবে গাড়ি আমদানি করলে) সেই করমুক্ত সুবিধার ওপর কর আরোপের বিষয়।
বাংলাদেশে টিওএন্ডইভুক্ত গাড়ির ধরন:
১. শুল্কমুক্ত আমদানিজনিত টিওএন্ডই:
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অনুমোদনক্রমে সরকারি ও বে-সরকারি দুই ভাবেই টিওএন্ডই পদ্ধতিতে গাড়ী আমদানি করা হয়। বাংলাদেশে টিওএন্ডইভুক্ত গাড়ী ব্যবহারকারী শ্রেণিগুলো হলো:
কূটনৈতিক গাড়ি (Embassy Car Bangladesh) – নীল প্লেট, করমুক্ত, বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত।
আন্তর্জাতিক সংস্থার গাড়ি – সবুজ প্লেট, সাধারণত Duty Free Car Bangladesh হিসাবে পরিচিত।
- সংসদ সদস্যদের গাড়ি- সরকারের মন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং উপদেষ্টাগণ এ সুবিধার আওয়ায় শুল্কমুক্ত গাড়ি ক্রয় করে থাকেন।
- সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের গাড়ি- সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা, প্রশাসনিক ( উপজেলা নির্বাহী অফিসার, জেলা প্রশাসক), সামরিক যানবাহন।
সরকারি প্রকল্পের গাড়ি – উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য করমুক্ত গাড়ি।
প্রতিবন্ধী কোটার গাড়ি – শুল্কমুক্ত সুবিধায় আনা যায়।
প্রবাসী কোটার গাড়ি – TOE NT Car Bangladesh হিসাবে রেকর্ড হয়।
২. টিওএন্ডই (TO&E) ভুক্ত গাড়ির সাধারণ পরিচিতি:
কোনো সরকারি অফিসের টিওএন্ডই তে অন্তর্ভুক্ত গাড়িটি সাধারণত দপ্তরের বিভিন্ন কার্যক্রম এবং কর্মকর্তাদের প্রয়োজনে ব্যবহার করা হবে। এই গাড়ি ব্যবহারের জন্য সরকারি নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। সংক্ষেপে, টিওএন্ডই ভুক্ত গাড়ি হল সরকারি কাজের জন্য নির্দিষ্ট এবং সরকারি নিয়মকানুন দ্বারা পরিচালিত একটি যানবাহন। টিওএন্ডই ভুক্ত গাড়ি চেনার উপায় কিংবা সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো:
- টিওএন্ডই (TO&E) যানবাহন হলো সরকারি দপ্তর বা সংস্থার সাংগঠনিক কাঠামো এবং সেখানে নিয়োজিত গাড়ি।
- এই যানবাহনগুলি সরকারি কাজে ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট করা থাকে।
- এগুলো সাধারণত সরকারি কর্মকর্তাদের পরিবহন, সরকারি বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা বা জরুরি প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ করা হয়।
- এসব গাড়ির ব্যবহার এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকার নির্ধারিত নিয়মকানুন অনুসরণ করতে হয়।
- এসব গাড়ির ব্যবহার এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারের অর্থ সংস্থান করতে হয় অর্থাৎ সরকারি অর্থ ব্যয় হয়।
- কোন কর্মকর্তার পদের বিপরীতে তার যাতায়াতের জন্য বরাদ্দ করা হয়।
- কোন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের যাতায়াত কিংবা প্রশাসনিক কাজে নিয়জিত।
- এসব গাড়ি চালানোর জন্য জনবল কাঠামোতে গাড়ীচালকের পদবি নির্দিষ্ট থাকে।
- এসব গাড়িচালকের পদবি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা থাকে।
টিওএন্ডইভুক্ত গাড়ির ড্রাইভার
টিওএন্ডইভুক্ত গাড়ির ড্রাইভার” বলতে “টিওএন্ডইভুক্ত গাড়ির চালক” বোঝায়। যা সরকারি কর্মকর্তাদের ভ্রমণ ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ বরাদ্দকৃত অর্থকে নির্দেশ করে।
টিওএন্ডইভুক্ত গাড়ির ড্রাইভার হলেন এমন একজন সরকারি কর্মচারী, যিনি টিওএন্ডই-এর আওতায় বরাদ্দকৃত সরকারি গাড়ি পরিচালনা করেন। তার দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে উক্ত গাড়ির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের অফিসিয়াল কাজে পরিবহন নিশ্চিত করা।
টিওএন্ডইভুক্ত গাড়ির ড্রাইভার অর্থ এমন সরকারি চালক, যিনি টিওএন্ডই বরাদ্দের আওতায় সরকারি কর্মকর্তাদের বহনের দায়িত্ব পালন করেন।
টিওএন্ডই ভুক্ত গাড়ি ও আউটসোর্সিং ড্রাইভার নিয়োগ
সরকারের বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় ড্রাইভার নিয়োগের বিধান রয়েছে। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবাগ্রহণ নীতিমালা-২০২৫ জারি করেছে। সেখানে সরকারি দপ্তরে বেশি প্রয়োজন এমন কয়েকটি পদের মধ্যে ড্রাইভার নিয়োগের বিধান রাখা হয়েছে। সেটি হলো:
(গ) আউটসোর্সিং সেবা প্রদানে বিবেচ্য বিষয়সমূহ অফিস সহায়ক ও টিওএন্ডইভুক্ত গাড়ির ড্রাইভার ব্যতীত গ্রেড ১৬ থেকে গ্রেড ২০ পর্যন্ত পদসমূহ আউটসোর্সিং এর জন্য বিবেচনাযোগ্য হবে, তবে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের যৌক্তিকতার আলোকে অর্থ বিভাগ অপরিহার্য সেবাসমূহ বিবেচনায় নিয়ে আউটসোর্সিং এর আওতাবহির্ভূত রাখতে পারবে।
এক্ষেত্রে আপনাকে TO&E ভুক্ত গাড়ি চেনার উপায় জানতে হবে। নিচের শর্তগুলো পূরণ করলে সেই গাড়ির জন্য আউটসোর্সেং প্রক্রিয়ায় ড্রাইভার নিয়োগ করা যাবে।
- গাড়িটি টিওএন্ডইভুক্ত না।
- গাড়ির ব্যবহার এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকার নির্ধারিত নিয়মকানুন অনুসরণ করতে হয় না।
- গাড়িটি কোন কর্মকর্তার পদের বিপরীতে তার যাতায়াতের জন্য বরাদ্দ করা হয় নাই।
- কোন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের যাতায়াত কিংবা প্রশাসনিক কাজে নিয়জিত না।
- এসব গাড়ি চালানোর জন্য জনবল কাঠামোতে গাড়ীচালকের পদবি নির্দিষ্ট নেই।
- গাড়িচালকের পদবি স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা নেই।
টিওএন্ডইভুক্ত গাড়ি চেনার উপায়
কোন গাড়ি টিওএন্ডই ভুক্ত কিনা, তা বিভিন্ন উপায়ে চেনা যায়। গাড়িটি শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা কিনা, সেটি হলো অভ্যান্তরীণ বিষয়। আর বাহ্যিক ভাবেও বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে চেনা যায়। টিওএন্ডইভুক্ত গাড়ি চেনার উপায় গুলো হলো:
১. নম্বরপ্লেট দেখে চেনা
নীল প্লেট = কূটনৈতিক গাড়ি
সবুজ প্লেট = আন্তর্জাতিক সংস্থার গাড়ি
সাদা/কালো প্লেট = ব্যক্তিগত রেজিস্ট্রেশন, কিন্তু RC Book-এ “TOE” বা “Duty Free” লেখা থাকতে পারে
২. রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট (BRTA রেকর্ড)
RC Book বা স্মার্ট কার্ডে “TOE”, “Shulkomukt” বা “Duty Free” লেখা থাকলে সেটি করমুক্ত গাড়ি।
মালিকানা যদি “Embassy” বা “Govt Project” হয়, সেটিও শুল্কমুক্ত গাড়ির প্রমাণ।
৩. কাস্টমস ডকুমেন্টস যাচাই
কাগজপত্রে “Diplomatic Privilege” বা “Duty Free Vehicle Bangladesh” লেখা থাকবে।
৪. দাম অস্বাভাবিক কম হলে
শুল্ক না দেওয়ায় TOE গাড়ির দাম সাধারণ গাড়ির তুলনায় কম হয়।
৫. মালিকানা ইতিহাস চেক করা
টিওএন্ডইভুক্ত গাড়ি কেনার আগে করণীয়
শুল্ক ছাড়ের মেয়াদ শেষ হয়েছে কিনা যাচাই – অনেক TO&E গাড়ি ৩–৫ বছরের আগে বিক্রি করা যায় না।
শুল্ক বকেয়া আছে কিনা দেখুন – শুল্ক বাকি থাকলে নতুন ক্রেতাকেই পরিশোধ করতে হয়।
রেজিস্ট্রেশন আপডেট চেক করুন – মালিকানা বদল BRTA-তে সঠিকভাবে রেকর্ড হয়েছে কিনা।
আইনগত সতর্কতা
TO&E গাড়ি কেনার পর আইনগত শর্ত না মানলে মামলা হতে পারে।
করমুক্ত গাড়ি বিক্রির শর্ত ভঙ্গ করলে শুল্ক পরিশোধ ও জরিমানা দিতে হতে পারে।
সুবিধা
বাজার দামের তুলনায় কম দামে পাওয়া যায়।
সাধারণত ভালো কন্ডিশনে থাকে।
অসুবিধা
বিক্রির ক্ষেত্রে আইনগত সীমাবদ্ধতা থাকে।
শুল্ক বকেয়া থাকলে নতুন মালিকের দায়।
বাংলাদেশে টিওএন্ডই ভুক্ত গাড়ি চেনার উপায় জানা প্রতিটি ক্রেতার জন্য জরুরি। করমুক্ত বা কূটনৈতিক গাড়ি কেনার আগে অবশ্যই কাগজপত্র, BRTA রেকর্ড ও কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স যাচাই করুন। সঠিকভাবে যাচাই করলে TO&E গাড়ি কেনা লাভজনক হতে পারে, কিন্তু অসতর্ক হলে আর্থিক ও আইনগত ঝুঁকিতে পড়ার সম্ভাবনা বেশি।