WordPress SEO

নারীবাদ কী? নারীবাদ ধারণার উদ্ভব ও উৎপত্তি

নারীবাদ কী?

আজকের বিশ্বে “নারীবাদ” বা Feminism একটি বহুল আলোচিত বিষয়। কেউ এটিকে নারী জাগরণের প্রেরণা বলে মনে করেন, আবার কেউ এটিকে সমাজে বিভাজন সৃষ্টিকারী একটি আন্দোলন মনে করেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো—নারীবাদ আসলে কী? পশ্চিমা নারীবাদ কী শিক্ষা দেয়? আর ইসলাম নারীর অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে কী বলে? চলুন বিশ্লেষণ করি।

নারীবাদ (Feminism) হলো একটি সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক মতবাদ ও আন্দোলন, যার মূল লক্ষ্য হলো—নারী ও পুরুষের মাঝে সমান অধিকার ও সমান মর্যাদা নিশ্চিত করা। নারীবাদ নারীদের প্রতি বিদ্যমান বৈষম্য, শোষণ, সহিংসতা ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে নারীর স্বাধীনতা, সম্মান ও সমতা প্রতিষ্ঠা করতে চায়।

নারীবাদ ধার‌ণার উদ্ভব ও উৎপত্তি:

১৮–১৯ শতকে পশ্চিমা দেশগুলোতে নারীকে “দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক” হিসেবে বিবেচনা করা হতো। তার বিপরীতেই শুরু হয় নারীবাদ আলোচনা। পশ্চিমা নারীবাদ মূলত ইউরোপ ও আমেরিকার প্রেক্ষাপটে গঠিত নারীবাদের ধারা। তবে এটি প্রথম সামনে আসে ১৮৯৩ সালে। নিউজিল্যান্ড বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে নারীদের ভোটাধিকার দেয়ার মাধ্যমে নারীবাদের সূত্রপাত হয়। এরপর ধীরে ধীরে নারীবাদ ইস্যুটিকে লুফে নেয় আমেরিকা ও ইউরোপ। নিচে নারীবাদের কয়েকটি স্তর উল্লেখ করা হলো:

১. নারীবাদ: প্রথম তরঙ্গ- নারীর ভোটাধিকার (- ১৯৬০ পর্যন্ত) :

 পশ্চিমা দেশগুলোতে নারী “দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক” মর্যাদা পেত। ১৮৪৮ সালে নারীর নাগরিক অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে সেনেকা ফলস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর যুক্তরাজ্যে নারীর ভোটাধিকারের দাবীতে “সাফ্রাজেট আন্দোলন” নামে নারী আন্দোলন হয়।পরিস্থিতি বুঝে নিউজিল্যান্ড ১৮৯৩ সালে ও অস্ট্রেলিয়া ১৯০২ সালে নারীদের ভোটাধিকার দেয়। ১৯২০ সালে যুক্তরাষ্ট্র একই পথ অনুসরণ করে। যুক্তরাজ্য ১৯১৮ সালে শুধু ধনী/ বিত্তবান নারীদের ভোটাধিকার দিলেও আন্দোলনের মূখে ১৯২৮ সালে সব নারীদের ভোটাধিকার প্রদান করে।

২. নারীবাদ দ্বিতীয় তরঙ্গ- ব্যাক্তি ও যৌন স্বাধীনতা (১৯৬১-১৯৮০)

এই সময়কাল ছিল নারীবাদের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনের যুগ। দ্বিতীয় তরঙ্গ নারীবাদ প্রথম তরঙ্গের চেয়ে অনেক বিস্তৃত এবং গভীর ছিল। এটি নারীর ব্যক্তিগত, সামাজিক, ও রাজনৈতিক অধিকারগুলোর পাশাপাশি যৌন স্বাধীনতা সম্প্রসারণে ভূমিকা রাখে।

২.১ কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ ও বেতন:

“Equal Pay for Equal Work” স্লোগান ধারণ করে নারীরা দাবি জানায় তারা যেন পুরুষদের সমান বেতন ও পদোন্নতির সুযোগ পান। এই দাবির ফলে 1963 সালে যুক্তরাষ্ট্রে “Equal Pay Act” পাশ হয়। অনেক দেশে এ আইন কার্যকর আছে। বাংলাদেশেও সরকারি এবং বেসরকারি কর্পোরেট চাকরিতে নারীরা পুরুষের সমান বেতন ও পদোন্নতি পায়।

২.২ গর্ভপাত ও জন্মনিয়ন্ত্রণ:

এসময় নারীরা নিজের দেহের উপর নিজের অধিকার চায়। নারীরা যখন ইচ্ছা গর্ভধারণ করবে, যখন ইচ্ছা গর্ভপাত করবে। পুরুষের চাওয়া-পাওয়া বা ইচ্ছার দিকটি চুড়ান্তভাবে উপেক্ষিত হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭৩ সালে গর্ভপাতকে বৈধতা দিলেও ২০২২ সালে তা বাতিল করে। অনেক দেশে এ অধিকার নিশ্চিত করায় মূলত এ সময়েই জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল ব্যবহার শুরু হয়।

২.৩ যৌন স্বাধীনতা:

নারীরা নিজের ইচ্ছামতো যৌনতা চর্চা করার অধিকার চায়। নারীর যখন ইচ্ছা সেক্স  করবে। স্বামী চাইলেও নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সাথে সেক্স করতে পারবে না। আবার নারী চাইলে স্বামীর সেক্স করতে হবে। হউক তা ইচ্ছার বিরুদ্ধে। অন্যদিকে, এই দাবির সঙ্গে নারীর আত্মনিয়ন্ত্রণ, শরীরের ওপর অধিকার, এবং বৈবাহিক ধর্ষণের বিরুদ্ধেও আন্দোলন যুক্ত ছিল। স্ত্রীর সামান্য অমতে স্বামী সেক্স করলে স্ত্রী তা ধর্ষণ হিসেবে উল্লেখ করতে পারবে। সেইসাথে স্বামীর বিরুদ্ধে মামলাও রুজু করতে পারবে। ২০২৫ সালে বাংলাদেশে নারী সংস্কার কমিশনের নারীবাদিগণ বৈবাহিক ধর্ষণের বিষয়টি সামনে আনে। এতে দাম্পত্য জীবনে কলহ বৃদ্ধি, বিবাহ-বিচ্ছেদ বৃদ্ধি ও পুরুষের যৌন চাহিদার অধিকার ক্ষুন্ন হওয়ার সম্ভবনা থাকে।

নারীবাদ আন্দোলনের একটি চিত্র

৩. তৃতীয় তরঙ্গ – পরিচয়ের বৈচিত্র্য ও যৌন স্বাধীনতার উগ্রতা (১৯৯১–২০১০)

দ্বিতীয় তরঙ্গের পরে নারীবাদ কিছুটা থিতিয়ে পড়লেও ১৯৯০-এর দশকে আবার নতুন রূপে আবির্ভূত হয়। এই তরঙ্গ নারীবাদকে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয়—যেখানে নারীর পরিচয়, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, যৌনতা, শ্রেণি, জাতি, ধর্ম এবং লিঙ্গ পরিচয়ের ভিন্নতা গুরুত্ব পায়। নারীবাদের ৩য় তরঙ্গের কিছু বৈশিষ্ট হলো:

৩.১ নারীবাদ: পরিচয়ের রাজনীতি:

এই তরঙ্গে নারীরা শুধু ‘নারী’ পরিচয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে আরও বিস্তৃত পরিচয় নিয়ে হাজির হয়—যেমন কৃষ্ণাঙ্গ নারী, মুসলিম নারী, ট্রান্সজেন্ডার নারী, সমকামী নারী ইত্যাদি। এইসব পরিচয়ের ভিন্নতাকে গুরুত্ব দিয়ে নারীবাদীরা দাবি করেন—সবার অভিজ্ঞতা এক নয়, তাই সবার অধিকার ও প্রয়োজনও ভিন্ন হবে।

৩.২ ‘গার্ল পাওয়ার’ ও যৌনতার বাণিজ্যিকীকরণ:

তৃতীয় তরঙ্গে ‘Girl Power’ বা ‘নারীর শক্তি’ স্লোগানে নারীরা নিজেদের পোশাক, মেকআপ, যৌনতা এবং মিডিয়ার মাধ্যমে নিজেকে উপস্থাপন করার অধিকার চায়। তবে এই ‘শক্তি’ ব্যবহারের ধরন অনেক সময় এতটাই উগ্র ও অতিমাত্রায় ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে যে তা মূলধারার সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে নারীবাদকে বিকৃত করে ফেলে।

৩.৩ পশ্চিমা সংস্কৃতিতে ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান:

তৃতীয় তরঙ্গ নারীবাদীরা ধর্মীয় বিধিনিষেধকে ‘নারী বিরোধী’ বলে প্রচার করে। বিশেষত মুসলিম নারীর হিজাব বা পর্দা সম্পর্কে বলা হয়—এটি পুরুষতান্ত্রিক শৃঙ্খল। 

৩.৪ বিয়ে ও পরিবারের প্রতি বিতৃষ্ণা:

এই সময় নারীবাদীরা বিয়ে এবং পরিবারের গঠনকে পুরুষতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত করে। অনেকেই বলে—“বিয়ে হলো নারীর দাসত্বের শুরু”। তাই তারা বিয়েকে না বলার অধিকার, একক মাতৃত্ব, অথবা লিভ টুগেদার সম্পর্কের পক্ষে সোচ্চার হন। এর ফলে বিবাহ হার কমে যায়, পরিবার ভেঙে পড়ে, এবং সন্তানরা বেড়ে ওঠে ভঙ্গুর মানসিক পরিবেশে।

৪. চতুর্থ তরঙ্গ – ডিজিটাল ফেমিনিজম ও পুরুষ বিদ্বেষ (২০১১–বর্তমান)

নারীবাদের চতুর্থ তরঙ্গ শুরু হয় ২০১১ সালের পর থেকে, যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, হ্যাশট্যাগ আন্দোলন এবং অনলাইন প্রচারণা নারীবাদী কর্মকাণ্ডের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে। এই তরঙ্গ মূলত ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম-কে ব্যবহার করে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা, যৌন হয়রানি ও সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে সরব হয়। তবে এই তরঙ্গে অনেক সময় পুরুষ বিদ্বেষ, চরম একপেশে দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের প্রবণতাও লক্ষ করা যায়।

৪.১ ডিজিটাল নারীবাদ ও হ্যাশট্যাগ বিপ্লব:

এই সময় নারীবাদ মূলত সোশ্যাল মিডিয়া ভিত্তিক আন্দোলন হয়ে দাঁড়ায়। আন্দোলনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী নারীরা তাদের উপর ঘটে যাওয়া যৌন হয়রানির গল্প শেয়ার করতে থাকেন। হ্যাশট্যাগের মাধ্যমে পুরুষদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার অভিযোগ সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক ধর্ষণ বা যৌন হয়রানির মামলা সামনে আসে, যা আগের সমাজে চেপে যেত। তবে বিচার না হতেই বহু পুরুষকে জনসমক্ষে “ধর্ষক” বা “অপরাধী” তকমা দেওয়া হয়। অনেক ক্ষেত্রে অভিযোগ প্রমাণিত না হলেও পুরুষের কর্মক্ষেত্র, পরিবার ও সামাজিক জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। এই প্রবণতাকে অনেকে বলেন “ডিজিটাল বিচার ব্যবস্থা” বা “মিডিয়া ট্রায়াল”।

৪.২ যৌনতা ও শরীরের প্রদর্শন:

এই তরঙ্গে নারীরা নিজেদের শরীরকে সম্পূর্ণভাবে তাদের “ব্যক্তিগত সম্পত্তি” ঘোষণা করে। “My Body, My Choice”—এই স্লোগানের আড়ালে নারীরা যেকোনো পোশাক পরা, খোলামেলা ছবি পোস্ট করা, এমনকি OnlyFans বা নগ্নতা নির্ভর প্ল্যাটফর্মেও কাজ করাকে “নারীর অধিকার” বলে প্রচার করে। অনেক নারী বলছেন, এ তাদের স্বাধীনতা। সমালোচকেরা বলেন, এভাবে নারীর সম্মান ও মর্যাদাকে তারা নিজেরাই পণ্যে পরিণত করছেন। 

৪.৩ পুরুষ বিদ্বেষ ও টক্সিক ফেমিনিজম

চতুর্থ তরঙ্গ নারীবাদে কিছু নারীবাদী গোষ্ঠী শুধু নারীর অধিকারের কথা না বলে পুরুষদেরকে সমাজের মূল সমস্যার মূল উৎস হিসেবে দেখাতে শুরু করে। এই চরমপন্থী মনোভাবকে বলা হয় “Toxic Feminism” বা “Radical Feminism”। এর নেতিবাচক দিকগুলো হলো:

  • পুরুষদের ‘toxic masculinity’ বা ‘বিষাক্ত পুরুষত্ব’ বলা হয়, কিন্তু নারীর নিজের আচরণ নিয়ে কথা বলা হয় না।

  • অনেক সময় শুধুমাত্র পুরুষ হওয়ার কারণে পুরুষদের দমন করার পক্ষে মত দেওয়া হয়।

  • কিছু দেশে পুরুষ ও নারীর আইনি ভারসাম্য চরমভাবে নারীদের দিকে ঝুঁকে পড়েছে, ফলে পুরুষরা হয়রানির শিকার হলেও ন্যায়বিচার পায় না।

৪.৪ পরিবার, বিয়ে ও মাতৃত্বের প্রতি বিদ্বেষ

এই তরঙ্গে বিয়ে-বিচ্ছেদ, একক মাতৃত্ব, গর্ভপাত, লিভ টুগেদার—এসব বিষয়কে প্রচণ্ডভাবে প্রোমোট করা হয়। ‘স্বাধীনতা’ আর ‘অধিকার’-এর নামে পরিবার ও সমাজ কাঠামোকে দুর্বল করে ফেলা হয়। বিয়েকে “পুরুষতান্ত্রিক শৃঙ্খল” বলা হয়। গর্ভপাতকে নারীর অধিকার বলা হলেও, গর্ভস্থ শিশুর প্রাণের অধিকার একেবারে উপেক্ষিত থাকে।

৪.৫ ইসলাম ও চতুর্থ তরঙ্গ নারীবাদ

এই তরঙ্গে পশ্চিমা নারীবাদীরা ইসলামি পোশাক, হিজাব, পর্দা ইত্যাদিকে ‘নারী নিপীড়নের প্রতীক’ বলে সমালোচনা করে। অথচ বহু মুসলিম নারী নিজের ইচ্ছায় হিজাব বা পর্দা গ্রহণ করেন। পশ্চিমা নারীবাদ এ জায়গায় এসে ‘পছন্দের স্বাধীনতা’ কথাটিকে নিজেদের সুবিধামতো ব্যাখ্যা করে, যা দ্বিচারিতার পরিচয়।

চতুর্থ তরঙ্গ নারীবাদ ডিজিটাল যুগে নারীর বিরুদ্ধে নির্যাতন ও হয়রানির বিষয়গুলো সামনে এনেছে, যা ইতিবাচক দিক। কিন্তু এর সঙ্গে পুরুষ বিদ্বেষ, নৈতিক অবক্ষয়, এবং পরিবারবিরোধী চিন্তাধারা যুক্ত হয়ে এটি ক্রমেই চরমপন্থী আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে। মুসলিম সমাজ ও রক্ষণশীল সংস্কৃতির দৃষ্টিকোণ থেকে এই নারীবাদ এক গভীর সাংস্কৃতিক সংকট তৈরি করছে, যেখানে নারী-পুরুষ সম্পর্ক অবিশ্বাস ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার স্তরে চলে যাচ্ছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *