বাংলাদেশে সরকারি কর্মচারীদের জন্য সাধারণ ভবিষ্য তহবিল (General Provident Fund – GPF) একটি সঞ্চয়মূলক তহবিল। এটি তাদের অবসরকালীন আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে গঠিত হয়েছে। এটি মূলত সরকারি চাকরিজীবীদের মাসিক বেতনের একটি নির্দিষ্ট অংশ কেটে রেখে সঞ্চয় হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। চাকরির শেষে বা নির্দিষ্ট কিছু পরিস্থিতিতে উত্তোলন করা যায়।
দুই ধরণের ভবিষ্য তহবিল রয়েছে। ১) সাধারণ ভবিষ্য তহবিল এবং ২) প্রদেয় ভবিষ্য তহবিল।
সাধারণ ভবিষ্য তহবিল (GPF):
পেনশনভুক্ত কর্মচারীদের ভবিষ্য তহবিলের নাম সাধারণ ভবিষ্য তহবিল। সরকারের রাজস্বখাতভুক্ত এবং কিছু স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পেনশন সুবিধা আছে। এ সকল প্রতিষ্ঠানে সাধারণ ভবিষ্য তহবিল সুবিধা চালু আছে। অর্থাৎ যেসকল প্রতিষ্ঠানে পেনশন সুবিধা আছে, সে সব প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্য তহবিলের নাম সাধারণ ভবিষ্য তহবিল। ইংরেজিতে General Provident Fund বলা হয়। সংক্ষেপে জিপিএফ (GPF) বলে।
সাধারণ ভবিষ্য তহবিলে সরকার বা প্রতিষ্ঠানের কোন অবদান থাকে না। শুধু বার্ষিক মুনাফা বা সুদ হার রয়েছে। সরকার প্রতিবছর নির্দিষ্ট হারে সুদ/মুনাফা দিয়ে থাকে। কর্মচারী যে টাকা জমা রাখে শুধু সেই টাকার উপর সুদ দেয়া হয়। এই মুনাফা সাধারনত উচ্চ হারে হয়ে থাকে। বর্তমানে এ হার ১৩% রয়েছে। কর্মচারী শুধু এই সুদাসল টাকা ফেরত পায়। এখানে টাকা রাখার সুবিধা হলো উচ্চ সুদ হার এবং ফেরতের নিশ্চয়তা।
প্রদেয় ভবিষ্য তহবিল (CPF):
সরকারের অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা পেনশন সুবিধা পায় না। ফলে, তাদের সাধারণ ভবিষ্য তহবিল সুবিধাও নেই। তবে, কিছু প্রতিষ্ঠানে ‘প্রদেয় ভবিষ্য তহবিল’ সুবিধা চালু আছে। ইংরেজিতে একে Contributory Provident Fund বলা হয়। সংক্ষেপে সিপিএফ (CPF) বলে।

জিপিএফ-এর ন্যায়, সিপিএফ-ও কর্মচারীর মাসিক বেতন থেকে কর্তন করা হয়। কিন্তু সিপিএফ-এর প্রধান সুবিধা হলো, কর্মচারী প্রতি মাসে যত টাকা কর্তন/জমা করবে, সরকার বা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানও কর্মচারীর সিপিএফ হিসাবে তত টাকা জমা করবে।
অর্থাৎ, কোনো কর্মচারী জানুয়ারি ২০২৫ মাসে তার প্রদেয় ভবিষ্য তহবিলে ৫,০০০ টাকা জমা করলে, সরকারও তার হিসাবে ৫,০০০ টাকা জমা করবে। ফলে, জানুয়ারি ২০২৫ মাসে তার মোট জমা হবে ১০,০০০ টাকা। কর্মচারী বছরে ৫০,০০০ টাকা জমা করলে, সরকার/প্রতিষ্ঠানও ৫০,০০০ টাকা জমা করবে। বছর শেষে তার মোট জমা হবে ১,০০,০০০ টাকা। সেই সঙ্গে, উক্ত প্রতিষ্ঠান নির্ধারিত হারে সুদ/মুনাফা পাবে।
সরকারও যেহেতু এ তহবিলে অবদান রাখে, তাই এটিকে ‘প্রদেয় ভবিষ্য তহবিল’ বলা হয়। একই পরিমাণ জমার বিপরীতে, জিপিএফ-এর তুলনায় সিপিএফ-এ দ্বিগুণ ফেরত পাওয়া যায়। প্রদেয় ভবিষ্য তহবিলে ফেরতেরও নিশ্চয়তা রয়েছে।
ভবিষ্য তহবিলে চাঁদা কর্তনের সময়:
স্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারীরা চাকরি জীবনের শুরু থেকেই ভবিষ্য তহবিলে চাঁদা কর্তন করতে পারেন। তবে শিক্ষানবিশ কাল শেষ হলে, এই চাঁদা কর্তন বাধ্যতামূলক। প্রতিষ্ঠানভেদে শিক্ষানবিশ কাল ৬ মাস থেকে ২ বছর পর্যন্ত হয়ে থাকে। শিক্ষানবিশ শেষ হলে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান কর্মচারীদের চাকরি স্থায়ী করার আদেশ জারি করে। আর এই আদেশ জারির পরের মাস থেকেই সাধারণ ভবিষ্য তহবিলে চাঁদা কর্তন করতে হয়।
উল্লেখযোগ্য যে, রাজস্বখাতভুক্ত চাকরিতে যোগদান করলেই চাকরি স্থায়ী হয় না। চাকরির শর্তাবলিতে উল্লেখ থাকে স্থায়ী ও রাজস্বখাতভুক্ত পদের বিপরীতে নিয়োগের বিষয়টি। তবে প্রতিটি চাকরির জন্য শিক্ষানবিশ কাল নির্ধারিত থাকে। শিক্ষানবিশ কাল সন্তোষজনক হলেই চাকরি স্থায়ী করা হয়, তা রাজস্ব খাতের বেতনভুক্ত হলেও।
চাঁদা কর্তনের হার:
মূল বেতনের ভিত্তিতে সাধারণ ভবিষ্য তহবিলে চাঁদা কর্তন করা হয়। একজন কর্মচারী তার মূল বেতনের সর্বনিম্ন ৫% এবং সর্বোচ্চ ২৫%-এর সমপরিমাণ টাকা সাধারণ ভবিষ্য তহবিলে জমা রাখতে পারেন। ৫% থেকে ২৫%-এর মধ্যে যেকোনো পরিমাণ সে কর্তন করতে পারেন।
সাধারন ভবিষ্য তহবিল চাঁদা, কর্তন না জমা?
যেহেতু ভবিষ্য তহবিলে কর্তন বাধ্যতামূলক, তাই এটিকে ‘চাঁদা’ বলা হয়। তবে চাঁদা সাধারণত ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকে না। সাধারণ ভবিষ্য তহবিলে জমাকৃত টাকা ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা রয়েছে। তাই এটিকে চাঁদা না বলে ‘জমা’ বলা শ্রেয়। এটি মাসিক বেতন থেকে কর্তন করা হয়। বেতনের বাইরে থেকে জমা দেওয়ার কোনো বিধান নেই। তাই এটিকে ‘কর্তন’ও বলা যেতে পারে। ফলে সাধারণ ভবিষ্য তহবিলের এই টাকাকে চাঁদা, জমা বা কর্তন—যেকোনো নামে ডাকতে পারেন। আবার এটিকে ‘সাধারণ ভবিষ্য তহবিলে কর্তনকৃত জমা’ও বলতে পারেন।
ভবিষ্য তহবিলের সুদ বা মুনাফার হার:
কর্তৃপক্ষ এই চাঁদার উপর একটি নির্দিষ্ট হারে সুদ প্রদান করে। সুদের হার পরিবর্তনযোগ্য। এটি সরকারের আর্থিক নীতির ওপর নির্ভর করে। প্রতিবছর এই হার পরিবর্তিত হতে পারে। সরকার চাইলে তা কমাতে বা বাড়াতে পারে। ১৯৮৫-১৯৯০ সালের দিকে এর গড়পড়তা হার ১৪.৫% ছিল। বর্তমানে সর্বোচ্চ হার ১৩% রয়েছে। অর্থবছরের শুরুতে বা মাঝামাঝি সময়ে সরকার সংশ্লিষ্ট অর্থবছরের মুনাফার হার নির্ধারণ করে এবং প্রজ্ঞাপন আকারে তা জারি করে। তবে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের নিজস্ব আইন/বিধি অনুযায়ী ভিন্ন হার জারি করতে পারে। জমাকৃত টাকার পরিমাণের ওপর ভিত্তি করে এই হারের ভিন্নতা রয়েছে। সাধারণত ৩ (তিন)টি ধাপে এর পরিমাণকে ভাগ করা হয়ে থাকে। সর্বশেষ কয়েক বছরের সাধারণ ভবিষ্য তহবিলের মুনাফার হার নিম্নে দেখানো হলো:
• প্রথম ১৫,০০,০০০/- (পনেরো লক্ষ) পর্যন্ত ১৩%;
• দ্বিতীয় পনেরো লক্ষ অর্থাৎ ১৫,০০,০০১ থেকে ৩০,০০,০০০/- পর্যন্ত ১২%;
• ত্রিশ লক্ষের উপরে অর্থাৎ ৩০,০০,০০১/- থেকে পরবর্তী যেকোনো পরিমাণে ১১% মুনাফা দেওয়া হয়।
সাধারণ ভবিষ্য তহবিলের অতিরিক্ত অর্থ সুদ নাকি মুনাফা?
ভবিষ্য তহবিলে জমার বিপরীতে যে অর্থ সরকার দিয়ে থাকে, তা সুদ না মুনাফা, তা নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে। কেউ এটিকে সুদ বলেন, আবার অনেকে মুনাফা বলতে ভালোবাসেন।
এই হার সময় শেষ হওয়ার আগেই নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। জমার বিপরীতে কত টাকা বেশি পেতে যাচ্ছে তা আগেই নির্ধারিত এবং জানা যায়। তাই এটিতে মুনাফা না বলে সুদ বলা যায়। সরকার এটিতে কোথাও সুদ, আবার কোথাও মুনাফা বলছে। যেমন, সরকারের বাজেট ও আয়-ব্যয় ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত পদ্ধতি আইবাস++-এ এটিকে ইংরেজিতে সুদ (Interest) বলা হয়েছে। সাধারণ ভবিষ্য তহবিলের টাকা উত্তোলনের ফরমে এটিকে বাংলায় সুদ বলা হয়েছে।
তবে বর্তমান সময়ে সরকার বিভিন্ন স্থানে এটিকে মুনাফা বলছে। সর্বশেষ এর হার নির্ধারণ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনে বাংলায় মুনাফার হার এবং ইংরেজিতে (Rate of Profit) বলা হয়েছে। আবার এটি সরকার কর্তৃক প্রদত্ত একটি আর্থিক সুবিধা বটে। বেতন ও অন্যান্য ভাতার মতো এটিও একটি আর্থিক সুবিধা। তাই, এটিকে সুদ না বলে মুনাফা বলা যায়।
ভবিষ্য তহবিলে চাঁদা কর্তনের সুবিধা:
সরকার নির্ধারিত সাধারণ ভবিষ্য তহবিলে চাঁদা কর্তনে আর্থিক নিরাপত্তা রয়েছে। এটি একটি নিরাপদ বিনিয়োগ। আছে সুদমুক্ত ঋণগ্রহণসহ নানা সুবিধা। সাধারণ ভবিষ্য তহবিলে চাঁদা কর্তনের সুবিধাগুলি:
১. অগ্রিম উত্তোলন সুবিধা: জরুরি প্রয়োজনে, যেমন চিকিৎসা, সন্তানদের শিক্ষা, বাসা নির্মাণ বা বিশেষ পারিবারিক কারণে অগ্রিম ঋণ নেওয়া যায়। কিছু নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে এ টাকা ফেরত দিতে হয় বা স্থায়ীভাবে কেটে রাখা হয়।
২. অবসরকালীন সুবিধা: অবসরের পর (বা মৃত্যুর পর) পুরো সঞ্চিত অর্থ ও সুদ একসাথে উত্তোলন করা যায়। কর্মচারীর মৃত্যুর ক্ষেত্রে তার মনোনীত ব্যক্তি এই টাকা পেতে পারেন।
৩. আয়করমুক্ত: সাধারণ ভবিষ্য তহবিলের জমাতে আয়কর আইনে বিনিয়োগ বলা হয়। আর এই বিনিয়োগের বিপরীতে আয়কর দিতে হয়না।
৪. অধিক মুনাফা: সাধারণত বর্তমান বাজার ব্যবস্থার চেয়ে এখানে মুনাফা বেশি পাওয়া যায়। ব্যাংক আমানত, ডিপিএস কিংবা এফডিআর যাই হোক না কেন, এগুলোর চেয়ে ভবিষ্য তহবিলে জমার মুনাফা বেশি।
কেন সাধারণ ভবিষ্য তহবিল এ চাঁদা কর্তন করবেন?
বেতন কম হলেও সরকারি চাকরি একটি শক্তিশালী আর্থিক সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। মাস শেষে যেমন বেতন পাবার নিশ্চয়তা রয়েছে, তেমনি সাধারণ ভবিষ্য তহবিলে জমাকৃত টাকাও ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা রয়েছে। কোন কর্মচারীর চাকরির শেষ সময় যেমনই চাকরির সময় শেষ হোক না কেন, টাকা তিনি বা তার পরিবার ফেরত পেতে পারেন। ভবিষ্য তহবিলে চাঁদা কর্তনের কয়েকটি সুবিধা নিচে দেয়া হলো:
• নিরাপদ সঞ্চয়: এটি সরকারি কর্মচারীদের জন্য একটি নিরাপদ বিনিয়োগ। এটি ভবিষ্যতে ফেরত পাওয়ার নিশ্চয়তা দেয়।
• উচ্চ মুনাফা: ব্যাংক আমানতের তুলনায় অপেক্ষাকৃত বেশি হারে মুনাফা পাওয়া যায়।
• কর রেয়াত সুবিধা: সাধারণ ভবিষ্য তহবিলে জমাকৃত অর্থ আয়কর মুক্ত।
• জরুরি সহায়তা: প্রয়োজন হলে অগ্রিম উত্তোলনের সুবিধা রয়েছে।