মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী অর্থনীতি ও উন্নত সুযোগ-সুবিধার দেশ হিসেবে পরিচিত। প্রতিবছর হাজার হাজার বাংলাদেশি নাগরিক আমেরিকায় যাওয়ার চেষ্টা করেন বিভিন্ন ভিসা ও ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা যাওয়ার উপায় এবং আমেরিকার ভিসার ধরণ সম্পর্কে জানতে চাইলে এই গাইডটি আপনার জন্য সর্বাধিক কার্যকর সহায়ক হতে পারে।
বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা যাওয়ার উপায়—এটি এমন একটি প্রশ্ন যা বহু মানুষ করে থাকেন, বিশেষ করে যখন তারা কাজ, শিক্ষা কিংবা আরও ভালো জীবনযাত্রার সুযোগ খুঁজছেন। যুক্তরাষ্ট্রে যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের জন্য আইনি প্রক্রিয়া, বিভিন্ন ভিসার ধরন এবং যোগ্যতার মানদণ্ড সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকা অত্যন্ত জরুরি।
এই ব্লগে আপনাকে আমেরিকায় যাওয়ার উপায় বিস্তারিতভাবে বুঝিয়ে দেব, যেখানে ২০২৫ সাল এবং তার পরবর্তী সময়ের জন্য সবচেয়ে সহজ অপশনগুলো, গুরুত্বপূর্ণ ধাপসমূহ এবং বিবেচ্য বিষয়গুলো তুলে ধরা হবে।
✅ আমেরিকার ভিসার ধরন ও সংক্ষিপ্ত বিবরণ
USA ইমিগ্রেশনের জন্য বিভিন্ন ধরনের ভিসা রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে পারিবারিক স্পনসরকৃত ভিসা, কর্মসংস্থানভিত্তিক ভিসা এবং ডাইভারসিটি ভিসা (DV লটারি)। প্রতিটি ভিসার বিস্তারিত বিবরণ ও যোগ্যতার মানদণ্ড ইউএসসিআইএস (USCIS)–এর সরকারি ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়।
মার্কিন ভিসাগুলো মূলত দুটি প্রধান শ্রেণিতে বিভক্ত:
(১) ইমিগ্রান্ট ভিসা – যা স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য প্রদান করা হয় এবং
(২) নন-ইমিগ্রান্ট ভিসা – যা অস্থায়ী ভ্রমণ, পড়াশোনা বা কাজের উদ্দেশ্যে দেওয়া হয়।
🟩 ১. ইমিগ্রান্ট ভিসা (গ্রিন কার্ড – স্থায়ী বাসস্থান)
এই ভিসাগুলো তাদের জন্য, যারা স্থায়ীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস ও কাজ করার পরিকল্পনা করছেন। স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য ইমিগ্রান্ট ভিসাগুলো হলো:
✅ ১.১ পরিবার স্পনসরশিপ ভিসা
IR (ইমিডিয়েট রিলেটিভ) ভিসা
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের স্বামী/স্ত্রী, পিতা-মাতা বা সন্তানদের জন্য।F (ফ্যামিলি প্রেফারেন্স) ভিসা
সম্প্রসারিত পরিবারের সদস্যদের জন্য, যেমন ভাই-বোন বা প্রাপ্তবয়স্ক সন্তানরা।
✅ ১.২ কর্মসংস্থানভিত্তিক ইমিগ্রেশন (ইবি ভিসা)
EB-1 – প্রায়োরিটি কর্মী (Priority Workers)
এই ভিসাটি দেওয়া হয় উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবী বা যাদের আছে অসাধারণ দক্ষতা, যেমন: মাস্টার্স বা পিএইচডি ডিগ্রিধারী, বিশেষায়িত গবেষক, অথবা বিশেষ ক্ষেত্রে দক্ষ পেশাজীবী। তারা যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে কাজ ও বসবাস করতে পারবেন।
EB-2 – উন্নত ডিগ্রিধারী পেশাজীবী (Professionals with Advanced Degrees)
এই ভিসাটি দেওয়া হয় উচ্চশিক্ষিত পেশাজীবী বা যাদের আছে অসাধারণ দক্ষতা, যেমন: মাস্টার্স বা পিএইচডি ডিগ্রিধারী, বিশেষায়িত গবেষক, অথবা বিশেষ ক্ষেত্রে দক্ষ পেশাজীবী। তারা যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে কাজ ও বসবাস করতে পারবেন।
EB-3 – দক্ষ শ্রমিক ও পেশাজীবী (Skilled Workers and Professionals)
এই ক্যাটাগরি হলো দক্ষ শ্রমিক, পেশাজীবী এবং অন্যান্য কর্মীদের জন্য যারা যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে কাজ করতে চান। যেমন: কারিগরি কর্মী, ইলেকট্রিশিয়ান, ও ফ্যাক্টরি কর্মী।
EB-4 – বিশেষ ইমিগ্রান্ট (Special Immigrants)
এই ভিসাটি দেওয়া হয় বিশেষ ক্যাটাগরির মানুষের জন্য, যেমন: ধর্মীয় কর্মী, ব্রডকাস্টার, বা বিশেষ সরকারি কর্মচারী যারা আমেরিকায় স্থায়ী বসবাসের জন্য আবেদন করেন।
EB-5 – ইমিগ্রান্ট বিনিয়োগকারী (Immigrant Investors)
যারা যুক্তরাষ্ট্রে বড় পরিমাণে বিনিয়োগ করে নতুন চাকরি সৃষ্টি করেন, তাদের জন্য এই ভিসা। এই বিনিয়োগকারীরা গ্রীন কার্ড পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাস ও ব্যবসা পরিচালনা করতে পারেন।
✅ ১.৩. Diversity Visa Lottery (DV Program) – ডিভি লটারির মাধ্যমে আমেরিকায় ইমিগ্রেশন
Diversity Visa Lottery (DV Program) হলো একটি সরকারিভাবে পরিচালিত প্রোগ্রাম, যার মাধ্যমে কিছু নির্দিষ্ট দেশের মানুষ, যেমন বাংলাদেশ, কোনো স্পনসর বা চাকরির অফার ছাড়াই যুক্তরাষ্ট্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের (Green Card) সুযোগ পান।
📌 DV Lottery-র গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো:
প্রতি বছর প্রায় ৫০,০০০ মানুষকে আমেরিকায় স্থায়ী বসবাসের সুযোগ দেওয়া হয়।
এই প্রোগ্রামে আবেদন করার জন্য উচ্চতর যোগ্যতা প্রয়োজন হয় না—শুধু উচ্চমাধ্যমিক পাস এবং নির্দিষ্ট কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়।
এটি পুরোপুরি লটারিভিত্তিক, মানে সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিজয়ীদের নির্বাচন করে।
যাঁরা DV Lottery তে নির্বাচিত হন, তাঁরা spouse ও সন্তানদের নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারেন।
⚠️ ডাইভার্সিটি ভিসা – ডাইভার্সিটি ইমিগ্র্যান্ট ভিসা প্রতারকদের থেকে সাবধান!
২০১২ সালে বাংলাদেশ ডাইভার্সিটি ভিসা (DV) প্রোগ্রামের জন্য অযোগ্য হয়ে যায়, কারণ ২০০৭-২০১২ সালের মধ্যে ৫০,০০০ এর বেশি বাংলাদেশি নাগরিক যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন করেছে। ডিভি প্রোগ্রাম মূলত সেইসব দেশের জন্য, যেসব দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কম।
🟨 2. নন-ইমিগ্রান্ট ভিসা (অস্থায়ী) Non-Immigrant Visas (Temporary Stay)
অস্থায়ী ভিসা (Non-Immigrant Visa) হল এমন একটি ভিসা যা যুক্তরাষ্ট্রে অস্থায়ীভাবে থাকার উদ্দেশ্যে প্রদান করা হয়। আপনি যদি পড়াশোনা, চিকিৎসা, কাজ অথবা ভ্রমণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে সাময়িকভাবে থাকতে চান, তাহলে এই ভিসা ক্যাটাগরির আওতায় আবেদন করতে হবে।
🎓 Student Visas (Study in the USA)
যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনার জন্য যারা যেতে চান, তাদের জন্য Student Visa USA অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও জনপ্রিয় একটি ভিসা ক্যাটাগরি। এই ভিসার অধীনে তিনটি প্রধান ধরণের ভিসা রয়েছে:
১. 🎓 F-1 Visa – Academic Students
✅ যারা কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে চান, তারা F1 Visa USA আবেদন করেন।
✅ এটি সবচেয়ে প্রচলিত স্টুডেন্ট ভিসা, এবং ফুল-টাইম একাডেমিক কোর্সে ভর্তি ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য প্রযোজ্য।
✅ F-1 ভিসায় শিক্ষার্থী পার্ট-টাইম অন-ক্যাম্পাস কাজ করতে পারেন এবং CPT/OPT-এর সুবিধা পেতে পারেন।
F-1 Visa এর প্রধান সুবিধা:
আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ
পড়াশোনার পাশাপাশি কিছু সময় কাজের অনুমতি
OPT-এর মাধ্যমে চাকরির অভিজ্ঞতা
২. 🎓 M-1 Visa – Training Students
✅ যারা টেকনিক্যাল বা ভোকেশনাল ট্রেনিং (যেমন: ইলেকট্রিশিয়ান, মেকানিক্যাল ট্রেনিং) নিতে চান, তাদের জন্য M1 Visa USA উপযুক্ত।
✅ একাডেমিক ডিগ্রির পরিবর্তে হাতে-কলমে শেখার কোর্সে ভর্তি হলে এই ভিসার প্রয়োজন হয়।
M-1 Visa এর প্রধান সুবিধা:
প্র্যাকটিক্যাল স্কিল উন্নয়নের সুযোগ
নির্দিষ্ট মেয়াদের জন্য ট্রেনিং সম্পন্ন করার সুযোগ
অল্প খরচে পেশাগত প্রশিক্ষণ
৩. 🎓 J-1 Visa – Exchange Visitors (Students, Researchers)
✅ J1 Exchange Visitor Visa মূলত এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে যুক্ত শিক্ষার্থী, ইন্টার্ন, গবেষক, শিক্ষকদের জন্য।
✅ এটি সাধারণত সরকারের বা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পন্সর করা প্রোগ্রামের আওতায় দেওয়া হয়।
J-1 Visa এর প্রধান সুবিধা:
আন্তর্জাতিক একাডেমিক ও সাংস্কৃতিক বিনিময়
গবেষণা ও ইন্টার্নশিপের সুযোগ
বিভিন্ন পেশাগত ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতা অর্জন
✳️ এই তিনটি ভিসার মাধ্যমেই আপনি study in the USA করতে পারবেন, তবে প্রতিটির নিয়ম-কানুন আলাদা। আপনি কোন ভিসার জন্য যোগ্য, তা নির্ভর করবে আপনার কোর্স ও ইনস্টিটিউশনের ওপর।
💼 Work Visas (কাজের জন্য অস্থায়ী ভিসা)
Non-Immigrant Visa (অস্থায়ী ভিসা) হল এমন একটি ভিসা যা যুক্তরাষ্ট্রে অস্থায়ীভাবে থাকার উদ্দেশ্যে প্রদান করা হয়। আপনি যদি পড়াশোনা, চিকিৎসা, কাজ অথবা ভ্রমণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে সাময়িকভাবে থাকতে চান, তাহলে এই ভিসা ক্যাটাগরির আওতায় আবেদন করতে হবে।
১. 💼 H-1B ভিসা – দক্ষ ও বিশেষায়িত পেশাজীবীদের জন্য
এই ভিসাটি মূলত এমন বিদেশি নাগরিকদের জন্য যাঁরা কোনো নির্দিষ্ট ক্ষেত্র যেমন আইটি, ইঞ্জিনিয়ারিং, মেডিকেল, ফিনান্স বা গবেষণায় বিশেষ দক্ষতা রাখেন এবং যাঁদেরকে মার্কিন কোনো কোম্পানি চাকরি দেওয়ার জন্য স্পন্সর করে।
২. 💼 L-1 ভিসা – কোম্পানির ভিতরের কর্মী স্থানান্তরের জন্য
যেসব কর্মীরা একটি আন্তর্জাতিক কোম্পানির অন্য দেশে কাজ করছেন এবং যাঁদেরকে ইউএস অফিসে স্থানান্তর করা হবে, তাদের জন্য এই ভিসাটি প্রযোজ্য। এটি L-1A (ম্যানেজার) ও L-1B (বিশেষ জ্ঞানসম্পন্ন কর্মী) নামে দুই ধরণের হয়ে থাকে।
৩. 💼 O-1 ভিসা – অসাধারণ প্রতিভাধারীদের জন্য
শিল্প, বিজ্ঞান, শিক্ষা, ব্যবসা বা ক্রীড়াক্ষেত্রে অসাধারণ প্রতিভা ও অবদানের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা এই ভিসার জন্য আবেদন করতে পারেন।
৪. 💼 P-1/P-2 ভিসা – ক্রীড়াবিদ, শিল্পী, বিনোদনকর্মীদের জন্য
P-1 ভিসা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ক্রীড়াবিদদের জন্য এবং P-2 ভিসা পারফর্মিং আর্টিস্টদের জন্য, যাঁরা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক এক্সচেঞ্জ বা শোতে অংশ নিতে চান।
🧳 Visitor Visas (অস্থায়ী ভ্রমণ ভিসা)
যারা ব্যবসায়িক কাজ, পর্যটন, চিকিৎসা অথবা আত্মীয়দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যুক্তরাষ্ট্রে স্বল্প সময়ের জন্য যেতে চান, তাদের জন্য Visitor Visa হলো একটি জনপ্রিয় আমেরিকার ভিসার ধরণ। এই ক্যাটাগরির মধ্যে দুইটি প্রধান ভিসা রয়েছে—B-1 ও B-2।
১. 🧳 B-1 Visa – ব্যবসায়িক ভ্রমণকারীরা
যেসকল ব্যাক্তি ব্যবসায়িক মিটিং, কনফারেন্স, চুক্তি আলোচনার উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রে আসেন, তাদের জন্য B-1 ভিসা। তবে এই ভিসায় চাকরি করা যায় না।
🧳 B-2 Visa – পর্যটক ও পারিবারিক ভিজিট
এই ভিসাটি মূলত ভ্রমণ, চিকিৎসা গ্রহণ, অথবা আত্মীয়-স্বজনকে দেখা করার জন্য। পর্যটক বা চিকিৎসার উদ্দেশ্যে যাদের ভ্রমণ, তাদের জন্য এটি উপযুক্ত।
🏥 মেডিকেল ও মানবিক ভিসা (Medical and Humanitarian Visas)
আমেরিকার ভিসার ধরণগুলোর মধ্যে মেডিকেল ও মানবিক ভিসাগুলো বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। এই ভিসাগুলি তাদের জন্য, যারা গুরুতর মানবিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন বা চিকিৎসার জন্য জরুরি ভিত্তিতে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের প্রয়োজন রয়েছে।
১. 🏥 U Visa – অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের জন্য
এই ভিসা তাদের জন্য যারা যুক্তরাষ্ট্রে কোনো অপরাধের (যেমন: নির্যাতন, শারীরিক আঘাত) শিকার হয়েছেন এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে সহযোগিতা করছেন।
২. 🏥 T Visa – মানবপাচারের শিকারদের জন্য
মানবপাচারের শিকার হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন বা আনা হয়েছে, তাদের সুরক্ষা ও পুনর্বাসনের জন্য এই ভিসা প্রদান করা হয়।
৩. 🏥 Humanitarian Parole – জরুরি মানবিক কারণের জন্য সাময়িক প্রবেশাধিকার
যেসব ক্ষেত্রে জরুরি চিকিৎসা, বিপদ থেকে বাঁচানো বা অন্য মানবিক প্রয়োজন দেখা দেয়, সেসব ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র সাময়িকভাবে প্রবেশের অনুমতি দিতে পারে।